আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সৃজনশীলতায় মুগ্ধ না হয়ে উপায় নেই। তাঁরা এখন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আমাদের যেসব দূতাবাস আছে, সেগুলোকে নির্দেশ দিয়েছেন ওসব দেশে কোনো বাংলাদেশি সাংবাদিক সফরে গেলে তাঁরা কোথায় কী করছেন তার ওপর নজর রাখতে হবে। তাঁদের বিবেচনায়, সাংবাদিকদের মতো ক্ষতিকর প্রাণীর বিরুদ্ধে নজরদারি ছাড়া ‘দেশের স্বার্থ এবং ভাবমূর্তি’র সুরক্ষা দেওয়া কঠিন।
ইংরেজিতে পাঠানো চিঠিতে ওই সভার সিদ্ধান্তটি বাংলায় তুলে ধরা হয়, যাতে লেখা হয়েছে, ‘বাংলাদেশ থেকে কোনো সাংবাদিক বিদেশে গিয়ে দেশের স্বার্থবিরোধী কোনো কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হচ্ছেন কি না, সে সম্পর্কে যথাযথ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হয় (বাস্তবায়ন: পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়)’ । এরপর বলা হয়েছে, উল্লেখিত কারণে বাংলাদেশি সাংবাদিকেরা যখনই তাঁদের স্বাগতিক দেশে সফর করবেন, তখনই তাঁদের কার্যকলাপ উদ্ঘাটনের (unearth) জন্য নজরদারি করতে হবে। দেশের স্বার্থ এবং ভাবমূর্তির বিরুদ্ধে তাঁদের যুক্ততা পাওয়া গেলে তাকে চিহ্নিত করে ওই ধরনের নেতিবাচক কার্যকলাপের প্রতিবেদন তাৎক্ষণিকভাবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে জানাতে হবে।
বিদেশে বাংলাদেশি সাংবাদিকদের ওপর নজরদারির নির্দেশ শিরোনামে বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরটি পড়ে প্রথমে বিশ্বাসই হয়নি যে সত্যিই এ রকম কিছু ঘটেছে। কিন্তু পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বহিঃপ্রচার বিভাগের মহাপরিচালক মো. লুৎফর রহমানের স্বাক্ষরিত চিঠিটি দেখে ভুল ভাঙল। চিঠিটি পড়লে শুধু সাংবাদিক কেন, যেকোনো নাগরিকই উদ্বিগ্ন হবেন। চিঠিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়বিষয়ক সংসদীয় কমিটির মতামত উদ্ধৃত করে এই ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। চিঠিতে বলা হয়েছে, ওই কমিটির দ্বাদশ সভায় অভিমত দেওয়া হয়েছে, ‘কোনো বাংলাদেশি সাংবাদিক বিদেশ সফরে গেলে তাঁর ওপর নজরদারি করতে হবে এবং দেশের স্বার্থবিরোধী কোনো কার্যকলাপের প্রমাণ পাওয়া গেলে তা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে জানাতে হবে।’ চিঠিতে এরপর বলা হয়, সংসদীয় স্ট্যান্ডিং কমিটি বিদেশে বাংলাদেশি সাংবাদিকদের নেতিবাচক কর্মকাণ্ডে তার উদ্বেগ প্রকাশ করেছে, কেননা এ ধরনের কার্যকলাপ আন্তর্জাতিক পরিসরে বাংলাদেশ সম্পর্কে ভুল ধারণা দেয়।
সংসদীয় কমিটির আলোচনা থেকে বোঝা যায়, পাকিস্তান কিছু সাংবাদিককে তাদের দেশটি সফর করিয়েছে। ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, জাপানসহ বিশ্বের বহুদেশই এভাবে সাংবাদিকদের আমন্ত্রণ জানায়, যেগুলোর উদ্দেশ্য হচ্ছে ওসব দেশের রাজনীতি, সমাজ, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ইত্যাদি সম্পর্কে তাঁদের জানানো। কিন্তু সাংবাদিকদের কেউ পাকিস্তানে কোনো রাষ্ট্রবিরোধী কাজ করেছেন এমন কোনো অভিযোগ কেউ করেননি। একজন সাংসদ বলেছেন, ওই সাংবাদিকদের কেউ কেউ বিভিন্ন ব্যক্তির সঙ্গে সাক্ষাৎ করে অপপ্রচার চালাচ্ছেন। তো অপপ্রচারের জবাব দেওয়ার জন্য সরকারের যেমন একাধিক দপ্তর আছে, তেমনই আছে অনেক লোকজন। সেখানে সাংবাদিকদের ওপর নজরদারির প্রশ্ন আসছে কেন? সাংবাদিকেরা পেশার প্রয়োজনে নানা উপলক্ষে বিদেশে যান। বিভিন্ন সভা-সেমিনার-প্রশিক্ষণের বিষয়ও থাকে। সেসব ফোরামে বাংলাদেশি হিসেবে নিজেদের ভালো-মন্দের কথা যে কেউ বলতেই পারেন। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জ, সংকট ও সম্ভাবনার কথা আলোচিত হতে পারে। সেগুলো সরকারের পছন্দ না হলেই কি রাষ্ট্রবিরোধী হিসেবে চিহ্নিত হবে? এ ধরনের গয়রহ নির্দেশনা তাই কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির ওই দ্বাদশ সভার কার্যবিবরণীর ওপর ভিত্তি করে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, ওই সভায় সাংসদ মাহজাবিন বলেছেন, ’গত কয়েক বছরে বাংলাদেশে অবস্থিত পাকিস্তান হাইকমিশন কিছুসংখ্যক বাংলাদেশি সাংবাদিককে পাকিস্তান সফরের আমন্ত্রণ জানায়। এসব সাংবাদিক বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন ব্যক্তির সঙ্গে সাক্ষাৎ করে অপপ্রচার চালাচ্ছেন। গণমাধ্যমে রাষ্ট্রবিরোধী কথাবার্তাসহ গণহত্যা বিষয়ে ভুল তথ্য দিচ্ছেন’। আলোচনা শেষে কমিটির সভাপতি দীপু মনি বলেছেন, ’সাংবাদিকদের বিদেশে যাওয়ায় কড়াকড়ি করা যায় না। তবে কোনো সাংবাদিক বিদেশে গিয়ে দেশবিরোধী কার্যক্রমে লিপ্ত হন কি না, সে বিষয়ে খোঁজখবর রাখা বা নজরদারি করা বাঞ্ছনীয়’।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী যতই বলুন যে বাংলাদেশের মতো স্বাধীন গণমাধ্যম বিশ্বে খুব কম দেশেই আছে, সে কথা সরকারের বাইরে কেউই বিশ্বাস করেন কি? বিপুল সংখ্যায় সংবাদপত্র ও বেসরকারি টেলিভিশনের অনুমতি দিলেই গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত হয় না। দেশে সংবাদপত্রের সংখ্যা কত, শুধু তা দিয়ে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা মাপার যুগ অনেক আগেই চলে গেছে। সরকার যেসব কথা শুনতে চায় না, যেসব সমালোচনা তাকে ক্ষুব্ধ করে, নির্ভয়ে সেসব কথা বলা এবং ভিন্নমত প্রকাশের সুযোগ আছে কি না সেটাই সবচেয়ে বড় বিবেচ্য। তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা, কথায় কথায় মানহানির মামলা, রাষ্ট্রদ্রোহের মতো গুরুতর অভিযোগের অপব্যবহার, গ্রেপ্তার, হুমকি এবং শারীরিক হামলার মতো বাস্তবতার কারণেই আমাদের গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সংকুচিত হয়েছে এবং হচ্ছে। চলতি মাসের গোড়াতেই সাংবাদিকতার স্বাধীনতা নিয়ে কাজ করে যেসব সংগঠন—রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস (আরএসএফ), কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টস (সিপিজে)—এরা সবাই বলছে, বাংলাদেশে মতপ্রকাশের অধিকার আরও সংকুচিত হয়েছে। প্রতিবছর সংবাদপত্রের স্বাধীনতার যে বৈশ্বিক সূচক আরএসএফ তৈরি করে, সেই প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্সে এ বছরে আমাদের অবনতি ঘটেছে। ১৮০টি দেশের মধ্যে আমাদের অবস্থান গত বছর ছিল ১৪৪, এবার ১৪৬। ফ্রিডম হাউসের মূল্যায়নেও বাংলাদেশের গণমাধ্যম মুক্ত নয়। গত বছরের তুলনায় তাদের হিসাবেও বাংলাদেশের সামগ্রিক অবস্থান এক পয়েন্ট কমেছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলী সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে বলেছেন, এর প্রয়োজন আছে। মাহমুদ আলী বলেন, ‘আমি সার্কুলার দেখিনি। দেখব এটা। জাতীয় স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য যারাই বিদেশে যাচ্ছে, তাদের সবার ওপরে নজর রাখা আমাদের কর্তব্য, সরকারের কর্তব্য। এর মানে এই নয় যে সবাইকে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে, অবশ্যই না। এ রকম স্বাধীন গণমাধ্যম পৃথিবীর কম দেশে আছে। এখানে যা খুশি তাই লেখা হচ্ছে। বিদেশে গেলে কী করছে সেটি দেখা উচিত। যদি স্বার্থবিরোধী কিছু করে তবে সেটাতে (দেখার ব্যাপারে) আপনাদেরও সমর্থন থাকা উচিত।’
আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী একজন ঝানু কূটনীতিক। তিনি তাঁর দীর্ঘ কূটনৈতিক জীবনে কখনো বিদেশে কোনো বাংলাদেশি সাংবাদিকের গতিবিধির খোঁজ নিয়েছেন কি না সেই কথাটি কি তিনি দেশবাসীকে জানাবেন? তিনি যেসব দেশে দায়িত্ব পালন করেছেন, সেই সব দেশের কোনো পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একই রকম কাজ করেছে বা করছে এমন কোনো দৃষ্টান্ত কি তিনি দিতে পারেন?
ভাষাবিদদের জিজ্ঞেস করলেই জানা যাবে ‘উদ্ঘাটন’ এবং ‘নজরদারি’র মতো শব্দগুলোতে সাধারণত অপরাধের গন্ধ পাওয়া যায়। এবং সে কারণে ওগুলো অপরাধবিষয়ক প্রতিবেদনেই ব্যবহৃত হয়ে থাকে। সুতরাং, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্তাদের ধন্যবাদ যে সাংবাদিকদের জন্য ওসব আপত্তিকর শব্দসংবলিত চিঠি দিয়ে তাঁরা বাংলাদেশের সাংবাদিকেরা কত অনুকূল পরিবেশে কাজ করেন তার এক নতুন দৃষ্টান্ত তৈরি করলেন। অবশ্য শুধু পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে দুষলে তাদের প্রতি কিছুটা অন্যায় করা হবে। কেননা, এর পেছনে মূল দায়টা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সদস্যদেরই বেশি। ওই কমিটির সভাপতি সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি। বিশ্বভ্রমণে তাঁর অভিজ্ঞতার ঝুলি খুবই সমৃদ্ধ। তিনিও যদি দ্বিতীয় আরেকটি দেশের দৃষ্টান্ত দেখাতে পারেন, যারা বিদেশে সাংবাদিকদের ওপর নজরদারি করে, তাহলে আমাদেরও কিছুটা জ্ঞানার্জন হতো! আমি নিশ্চিত, উত্তর কোরিয়ার মতো দু-একটি চরম কর্তৃত্ববাদী দেশ ছাড়া এমন কোনো দেশের নাম তিনি বলতে পারবেন, যেটি গণতন্ত্র হিসেবে স্বীকৃত।
ধারণা করি, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এই নির্বতনমূলক পদক্ষেপ আমাদের ভাবমূর্তিকে আরও নেতিবাচক অবস্থানে নিয়ে যাবে। গতকাল বৃহস্পতিবার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সংবাদদাতা সমিতি (ডিক্যাব)-এর সাবেক সভাপতি মাসুদ করিম পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে এ ধরনের নজরদারির আদেশ প্রত্যাহারের অনুরোধ জানিয়েছেন। তাঁর ওই দাবির সঙ্গে পূর্ণ সংহতি জানাই এবং আশা করি সরকার এই পথ থেকে সরে আসবে। কেননা, এটি এমন এক পদক্ষেপ, যা নিজে থেকেই দেশের ভাবমূর্তিকে খাটো করে। সর্বোপরি, এটি সাংবাদিকের পেশাগত কাজে বাধা সৃষ্টির পাশাপাশি তার স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশের গণতান্ত্রিক অধিকারের ওপর হামলার শামিল।